বাংলাদেশের চাপে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বদল
রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে বাংলাদেশের অসন্তোষ ও ব্যাপক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত অবস্থান বদল করেছে ভারত। রাখাইনে সহিংসতা ও বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল বন্ধে পদক্ষেপ নিতে নেপিদোকে আহ্বান জানিয়েছে নয়াদিল্লি। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে এ সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তা দেন। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠানো হয়েছে ত্রাণও। এছাড়া, রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুরাও নির্যাতিত হচ্ছেন– এমন খবরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে।
দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র স্বীকার করেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান নিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টি প্রকাশে কোনও রাখঢাক করেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে মিয়ানমার সফরের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতেই ঢাকার এই অসন্তুষ্টি। পরে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস. জয়শংকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্পষ্ট করেন, এই ইস্যুতে দিল্লির কাছে আরও ইতিবাচক ও দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে ঢাকা একটি সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বলেও উল্লেখ করেছেন মোয়াজ্জেম আলী।
গত ২৫ আগস্ট থেকে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আসছে। এর আগে থেকেই আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
দিল্লি ও কলকাতার সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, কূটনৈতিকভাবে ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-উভয় দেশের সঙ্গে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে এবং স্পর্শকাতর ইস্যুটিতে দিল্লি কোনও পক্ষে দাঁড়ায়নি। তবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক আকারে রাখাইন ছেড়ে আসায় বাংলাদেশের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া এবং বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক উদ্বেগজনক অবস্থা ভারতকে আরও বেশি বিচারমূলক অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করেছে। একইসঙ্গে এ সংকটে নিজেদের সম্পৃক্ততাও বৃদ্ধি করতে হয়েছে।
এছাড়া, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, রাখাইন প্রদেশে কুতুপালং গ্রামে মুসলিমবিরোধী সেনা অভিযানে অন্তত ৫০০ হিন্দুও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাদের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রাখা হয়েছে। তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির আইন শাখার প্রধান শান্তনু সিনহা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি জানান, দিল্লির সিনিয়র মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। তারা আশঙ্কা করছেন যদি মিয়ানমারকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া না হয়, তাহলে তাদের সম্প্রদায়ের (হিন্দু) মানুষদেরও ঢল নামতে পারে। শান্তনু আরও জানান, এরই মধ্যে বিজেপি নেতারা বিষয়টি মিয়ানমারের ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে’ তুলে ধরেছেন এবং আহ্বান জানিয়েছেন পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শান্ত করার।
এছাড়া, মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বারবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ করেছে ঢাকা। ২৭ আগস্ট এবং এরপরেও এই লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে। সীমান্তের মংডু এলাকায় মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে অভিযানের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার এই আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ফলে বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোন আলাপে নয়াদিল্লির অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। সুষমা জানিয়েছেন, সফরে মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেতা অং সান সু চিকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন মোদি। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি রাখা হয়নি। কারণ, সময় উপযুক্ত ছিল না। সুষমা আরও ইঙ্গিত দেন যে, মিয়ানমারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের আস্থা অর্জন যে জরুরি মোদি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। দিল্লিও ৪০ হাজার অবৈধ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভারত ও বাংলাদেশ একই অবস্থানে রয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রোহিঙ্গাদের মধ্যে থাকা জঙ্গিরা নকশাল ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষকরা উপসংহার টেনে জানান, বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাপে সুষমা স্বরাজের বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা ও কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য দ্রুত ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত এই ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বদলের প্রমাণ। শুধু তা-ই নয়, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ ও শরণার্থীদের ঢল বন্ধ করার জন্য মিয়ানমারকে ভারত আহ্বান জানিয়েছে।
তবে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন এনডিএ সরকার একমত যে, যেসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গি রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সব ধরনের অধিকার রয়েছে মিয়ানমারের। আল-কায়েদা, আইএস, লস্কর-ই-তৈয়বাসহ নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী সমর্থিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসীদের অনেকেই রোহিঙ্গা জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ভারত প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে ৫৩ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, লবণ, দুধ, চিনি ও মশারি। শিগগিরই আরও সাত হাজার টন ত্রাণ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। শিখদের একটি ত্রাণ সংগঠন খালসা ৫০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আরও বেশি ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি।
Reviewed by Xpromedia
on
September 17, 2017
Rating: 5
No comments